বিরুদ্ধ মত দমনে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

Published on 18/04/2023


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল ভীতির পরিবেশ তৈরি করা বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলেন, ভিন্নমত প্রকাশ নিয়ন্ত্রণেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছিল। এই আইনের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করার অধিকার হরণ করা হয়েছে। নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে এই আইন। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বিরুদ্ধ মত দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: এখন কী করতে হবে?’ শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকেরা এসব মত তুলে ধরেন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।

ওয়েবিনারের মূল আলোচক যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সিজিএসের উপদেষ্টা আলী রীয়াজ বলেন, যখন আইনটির খসড়া করা হয়েছিল, তখন থেকেই বলা হয়েছিল, এটি ভয়াবহ রূপ নেবে। স্বাধীন মতপ্রকাশ সীমিত করবে। সাড়ে চার বছর পর তাই দেখা যাচ্ছে। ভীতির পরিবেশ তৈরি করাই ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্য।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করে গত বছরের জুন মাসে সুপারিশমালা বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। এই প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, সরকার সুপারিশমালা পাওয়ার পরও অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। সরকার অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অংশীজনেরা এই আইন নিয়ে যেসব আপত্তি তুলেছে, সেগুলো কি সরকার আলোচনায় যুক্ত করেছে? সরকারের স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।

তিনি বলেন, এই আইন বাতিল করতে হবে। সরকার বলছে, আমরা দেখছি, করছি কিন্তু তারা বিষয়টি দেখছে না, করছে না। সরকার এই আইন নিয়ে অনমনীয়, এটি উদ্বেগের। নির্বাচনের আগে এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল না হওয়ার আগপর্যন্ত সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণে পাঁচটি করণীয় প্রস্তাব করেন আলী রীয়াজ। সেগুলো হচ্ছে: ১. পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা। কত দিনের জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হবে, তা সরকারই নির্ধারণ করবে। ২. এই আইনে কত মামলা, কোন ধারায়, কত আসামি, মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি, কতগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে, তার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা। ৩. এই আইনে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। প্রয়োজনে ১৫ দিন সময় বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৭৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে না। পুলিশ কত মামলায় সঠিক সময়ে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা প্রকাশ করা। ৪. এই মামলায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের জামিন দেওয়া। নারী হয়রানি, প্রতারণার অভিযোগে এই মামলায় গ্রেপ্তার কারও বিরুদ্ধে প্রমাণ না থাকলে দ-বিধি ও অন্য আইনে মামলা করা। ৫. এই মামলার ভুক্তভোগী যাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনটি বাতিল করতে হবে। নিবর্তনমূলক, নির্যাতনমূলক এই আইন মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। সংবিধান ও স্বাধীনতার পরিপন্থী এই আইন সরকারের সমালোচনার অধিকার হরণ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাক্স্বাধীনতার ওপর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, কিছু লেখার সময় চিন্তা করতে হয়, এটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পড়বে কি না। ডিজিটাল মাধ্যমে নিরাপত্তা দিতে আইনের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু আইনের যে প্রয়োগ, তা প্রশ্নবিদ্ধ।

নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের নির্বাচনসংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহ ও সম্প্রচার করার বিষয়ে ইসির নীতিমালার বিষয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই নীতিমালার ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের মতামত ব্যক্ত করার পরিস্থিতি থাকবে না। ভোটকক্ষে কোনো প্রার্থীর এজেন্ট নেই, এই তথ্য কেন দেখানো যাবে না, এটি বোধগম্য নয়। এই নীতিমালাও একধরনের সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের আইন।

সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচনের বছরে এই আইনের প্রয়োগ ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গ মাথায় নিয়ে বিরোধীদের পক্ষে মাঠে নামা কঠিন। ইসির পক্ষে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি কঠিন হবে। উদার গণতান্ত্রিক দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন থাকতে পারে না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় পাঁচ মাস কারাগারে ছিলেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থনৈতিক সমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া। তিনি বলেন, এই আইনের প্রয়োগই অপপ্রয়োগ। এই আইন দিয়ে ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। মানবিক বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকতে পারে না।

ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানকেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকার এই আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করবে বললেও কোনো সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। দেশের নাগরিকদের সাইবার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পাস হয়। কিন্তু এর বিস্তৃত পরিধি ও অস্পষ্ট বিধানের কারণে অশুভ উদ্দেশ্যে আইনটি প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে। সিজিএস এই আইনের ব্যবহার নিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গবেষণা করছে।

সিজিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১ হাজার ২৯৫টি মামলার সম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা গেছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৪৪ জন এবং তাঁর মধ্যে ১ হাজার ৩৭৮ জন আটক হয়েছিলেন। আটক ব্যক্তিদের অনেকে জামিনে মুক্ত হলেও অনেকেই বিচারাধীন অবস্থায় আটক আছেন।

News Courtesy:

https://dailyinqilab.com/national/article/569411