সোহরাব হাসান
জাতীয় নির্বাচনের আগে সাংবাদিকদের একটি কর্মশালায় যোগ দিতে পটুয়াখালী গিয়েছিলাম। সেই কর্মশালায় বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের ২০–২২ জন সাংবাদিক অংশ নেন।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানির প্রসঙ্গ আসতেই দুজন জানালেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) মামলা চলছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে আইনটি রহিত হলেও মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়নি।
শুধু ওই দুজন নন, সারা দেশে অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা চলমান আছে। ভুক্তভোগী সাংবাদিকদের মাসে মাসে আদালতে হাজিরা দিতে হয়।
আর্টিকেল ১৯-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে ৪৬টি, আসামি ৯১ জন। মানহানির মামলা হয়েছে ১৪টি, আসামি ৩০ জন। এ ছাড়া বাতিল হওয়ার আগপর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় ৩৩টি, অভিযুক্ত ৬০ জন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ রকম শত শত মামলা করা হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। বেশির ভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গত নভেম্বরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি মামলা থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। এর অর্থ তিনি আইনের দৃষ্টিতে কোনো অন্যায় করেননি। তারপরও তাঁকে ১৫ মাস জেল খাটতে হয়েছে।
দেশে-বিদেশে প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে সরকার গত বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন জারি করে। এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়। ফলে মামলা করলেই এখন হয়তো সাংবাদিককে জেলের ভাত খেতে হয় না। জামিন পেয়ে যান।
কিন্তু এই আইনেও কয়েকটি ধারা আছে, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চাইলেই সাংবাদিকের অফিস-বাসা তল্লাশি করতে পারেন। মালামাল জব্দ করতে পারেন। চরিত্রের দিক দিয়ে আইন দুটির মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই।
গত ফেব্রুয়ারিতে ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ও আইন সাংবাদিকতা’ শীর্ষক কর্মশালায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আইনের পাঁচটি ধারা (২২, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৮) যেকোনোভাবে আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে।…যদিও ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়ে হয়তোবা আপনারা জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কয়েকটা সেকশন খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে এই জার্নালিজমে (সাংবাদিকতায়)।’
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ কোনো নির্দিষ্ট সরকারের আমলের কথা বলেননি। বলেছেন ’৯১-পরবর্তী অসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা। সমস্যা হলো সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়াকেও অনেক সময়ে বৈরী দৃষ্টিতে দেখা হয়, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মধ্যেও ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘চক্রান্ত’ আবিষ্কার করা হয়। ’৯০-পরবর্তী সব সরকারের আমলেই এ ঘটনা ঘটেছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল হলেও এই আইনে অতীতে করা মামলা থেকে সাংবাদিকেরা রেহাই পাচ্ছেন না। কেউ কেউ কারাগারে আটক আছেন। অনেককে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। প্রায়ই স্থানীয় সাংবাদিকদের দেখি সহকর্মীদের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করতে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ১টি মামলা দায়ের হয়েছে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণায় দেখা যায়, ৫ বছরে এই আইনে ৪৫১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ৯৭ জন। সব চেয়ে বেশি মামলা হয় ২০২১ সালে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ মামলায় স্বচ্ছতা না থাকা, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, বিচার-পূর্ব আটক, শিশু-কিশোরদের আইনের আওতায় আনা এবং আইনের স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
গত বছরের ২৬ মার্চ প্রথম আলোর অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ারের সময় ‘গ্রাফিক কার্ড’ তৈরি করা হয়। সেই কার্ড নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা দুটি এখনো চলছে। ওই ঘটনায় প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার ২০ ঘণ্টা পর মামলা দেওয়া হয়। একই আইনে মামলা দেওয়া হয় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধেও। তাঁরা দুজনই বর্তমানে জামিনে আছেন এবং কিছুদিন পরপর তাঁদের আদালতে হাজির হতে হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ রকম শত শত মামলা করা হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। বেশির ভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গত নভেম্বরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি মামলা থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। এর অর্থ তিনি আইনের দৃষ্টিতে কোনো অন্যায় করেননি। তারপরও তাঁকে ১৫ মাস জেল খাটতে হয়েছে।
সে সময় প্রথম আলো অনলাইনে লিখেছিলাম, ‘আপিল বিভাগের আদেশে খাদিজা ১৫ মাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তাঁর লড়াই শেষ হয়নি। ডেমোক্লেসের তরবারির মতো তাঁর মাথার ওপর ঝুলছে বাতিল হওয়া ডিজিটাল আইনের দুটি মামলা। এখন তাঁকে মামলা লড়তে হবে।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল হলেও এই আইনের অধীন মামলাগুলো চলবে। কিন্তু যেখানে অপরাধই সংঘটিত হয়নি, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার বা শাস্তি হবে কী করে? আইনটি করাই হয়েছিল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে এবং ভিন্নমতকে দমন করতে।
এই আইনে দায়ের করা সাত হাজার মামলার মধ্যে যদি মাত্র ২ শতাংশের বিচার হয়ে থাকে, ধরে নিতে হবে বাকি মামলাগুলো ছিল হয়রানিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আইনে তদন্তকারী কর্মকর্তার ৯০ দিনের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করার কথা। বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি আরও ১৫ দিন সময় নিতে পারেন। কিন্তু যেসব মামলার তদন্তকাজ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখে সাংবাদিক বা অন্য অভিযুক্তদের হয়রানি করার যুক্তি নেই।
সাইবার নিরাপত্তা আইন পাসের ক্ষেত্রে সরকার অংশীজনদের মতামত নিলেও খুব আমলে নিয়েছে, বলা যাবে না। নতুন আইনে ১০টি ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে, যা আগের আইনে অজামিনযোগ্য ছিল। নতুন আইনে শাস্তির মেয়াদ ও পরিমাণ কমানো হয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল, নতুন আইনও তা প্রশমন করতে পারেনি। সাইবার নিরাপত্তা আইনেও পুলিশকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সাইবার নিরাপত্তা আইনেও সেই ভয় থেকে গেল।
৩০ এপ্রিল প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় স্থানীয় দুই সাংবাদিক জিয়াউল ইসলাম ও তওহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে সেখানে এক পক্ষ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই দুই সাংবাদিক সেটা প্রচার করেছেন। এটাই তাঁদের অপরাধ!
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হওয়ার পরও সেই আইনে করা মামলার পেরেশানিতে আছেন সাংবাদিকেরা।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি